Home » Featured » খালেদা জিয়ার মুক্তিতে একাট্টা ঐক্যফ্রন্ট
Processed with MOLDIV

খালেদা জিয়ার মুক্তিতে একাট্টা ঐক্যফ্রন্ট

তফসিল ঘোষণার দুই দিন আগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে সরকারকে জোরালো চাপ দিতে চাইছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জোট ঐক্যফ্রন্ট। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই জোটের সমাবেশে উপস্থিত সব নেতাই খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টিকে সামনে এনে বক্তব্য রেখেছেন।

ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বলছেন, চলমান সংলাপ ফলপ্রসূ করতে হলে খালেদা জিয়ার মুক্তি দিতে হবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দেওয়া সাত দফা দাবির মধ্যেও শুরুতেই রয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তির বিষয়টি। তাই সাত দফা দাবির সবগুলোই মানতে বাধ্য করার বিষয়ে ঐক্যফ্রন্ট একাট্টা থাকার অঙ্গীকার করেছে সমাবেশে।

মঙ্গলবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন। বিএনপি মহাসচিব ও ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব।

এদিকে, আগামীকাল বুধবার (৭ নভেম্বর) সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের দ্বিতীয় দফায় সংলাপ হওয়ার কথা রয়েছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে সমাবেশে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা তাদের বক্তব্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, আলোচনার ভিত্তিতে দাবি আদায় না হলে তারা আন্দোলনের পথ বেছে নিতেই বাধ্য হবেন।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

আলোচনার মাধ্যমে দাবি আদায় না হলে আগামী ৮ নভেম্বর রাজশাহী অভিমুখে রোড মার্চের কর্মসূচির ঘোষণা দেন ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এছাড়া রাজশাহীতে ৯ নভেম্বর জনসভার কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। তারপরও দাবি আদায় না হলে নির্বাচন কমিশন অভিমুখে লংমার্চ করার ঘোষণা দিয়েছেন ঐক্যফ্রন্টের এই মুখপাত্র।

তিনি বলেন, এই সরকার যদি আগামীকাল (বুধবার) সংলাপে আমাদের দাবি-দাওয়াগুলো মেনে না নেয়, তাহলে ৮ নভেম্বর রাজশাহীতে যাত্রা শুরু করব রোড মার্চ করে। রাজশাহীতে ৯ নভেম্বর জনসভা হবে। পরে খুলনা, বরিশাল ও ময়মনসিংহে ঐক্যফ্রন্ট জনসভা করবে জানালেও কোনো তারিখ বলেননি বিএনপি মহাসচিব।

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন যদি সমঝোতার আগে তফসিল ঘোষণা করতে চায়, তাহলে নির্বাচন কমিশন অভিমুখে পদযাত্রা হবে। এরপর আমরা আরও কর্মসূচি ঘোষণা করব।

সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত হাজার হাজার মিথ্যা মামলা করেছে সরকার। সাইবার দলের ২৫ জন নেতাকর্মীকে তুলে নেওয়া হয়েছে। কোনো সংবাদ নেই। অনেকে কারাগারে আছেন। অন্যায়ভাবে ব্যারিস্টার মইনুলকে কারাগারে রাখা হয়েছে। আমরা আগামীকাল আবারও সংলাপে যাব। সেখানে সব দাবি তুলে ধরা হবে। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই।

সমাবেশে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির জোরালো দাবি তুলেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে। প্রয়োজনে রক্ত ঝরবে, তবুও খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই।

মান্না বলেন, ‘বেগম জিয়াকে জেলে রাখা যাবে না। জীবন যাবে, তবুও তাকে (খালেদা জিয়া) মুক্ত করা হবে। আজ যারা ছবি তুলেছেন আর ভিডিও করেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এবং আইজিপি’র কাছে সেগুলো পাঠিয়ে দেন। তারা দেখুক, জনগণ খালেদা জিয়াকে কতটা ভালোবাসে।’

সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, মির্জা আব্বাস, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দীন সরকার, আবদুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ ইব্রাহিম, বিজেপি সভাপতি আন্দালিভ রহমান পার্থ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি নুর হোসেন কাশেমীসহ অন্যরা।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশ দুপুর ২টার পর শুরু হলেও সকাল ১১টা থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে নেতাকর্মীরা আসতে শুরু করেন। দুপুরের আগে আগেই সমাবেশস্থলে জনতার ঢল নামে। সমাবেশ ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুতি নেয়।

মাহমুদুর রহমান মান্না

সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সাত দফা দাবি সারাদেশের জনগণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার পদত্যাগ চাই। এই তফসিল চাই না, ভোটের আগে খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই। এ সময় উপস্থিত নেতাকর্মীদের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান তিনি।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, লাগামহীনভাবে দুর্নীতি করেছে এই সরকার। এবার আর পারবে না। মিথ্যা মামলা দিয়ে খালেদা জিয়াসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীকে জেলে দিয়েছে। এরপরেও আমরা রাজপথ ছেড়ে সংলাপে গিয়েছি। শান্তিপূর্ণভাবে সব সমাধান চেয়েছি। কিন্তু সরকারের কানে যাচ্ছে না। একদিকে সংলাপ, অন্যদিকে গ্রেফতার, আবার আরেকদিকে তফসিল— সবই নাটক বলে মনে হচ্ছে।

মওদুদ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৪টি মামলা ছিল। তিনি প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন। আমার নেত্রী যাননি। প্যারোলে মুক্তি নিয়েও যাবেন না। যেদিনই হোক, আন্দোলন করেই খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা হবে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, বোন, একবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে দেখুন— জনতা কী চায়। তিনি বলেন, আমি বিএনপিতে যোগ দেইনি, আমি ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছি।

কাদের সিদ্দিকী বলেন, একটা চাড়ালের কথার দাম আছে, তবু সেতুমন্ত্রীর কথার কোনো দাম নাই। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণতন্ত্র ও বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা হবে।

বলা হয়, বিএনপি রাজাকারের গাড়িতে পতাকা তুলে দিয়েছে, যা সঠিক নয়। রাজাকারের গাড়িতে পতাকা আওয়ামী লীগই দিয়েছে। মহিউদ্দিন ও আশিকুর রহমানের গাড়িতে পতাকা তুলে দেওয়া হয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, দেশে গণতন্ত্র নেই। দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার অধিকার আছে আইনি প্রক্রিয়ায় জামিন পাওয়ার। কিন্তু তাকে জামিন দেওয়া হচ্ছে না। তাকে প্যারোলে মুক্তি দিতে হবে। তিনি বলেন, এই সরকারের কবর হবে। বিএনপিকর্মীরা গুলি খাবে, মারা যাবে, কিন্তু আপস করবে না।

তিনি বলেন, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। সেনাবাহিনী ছাড়াও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও ট্রাস্টি ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বিনা বিচারে মানুষ মারা থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধ করে চলেছে এই সরকার। উন্নয়নের কারণে সরকারের কানে পানি জমেছে, দুর্নীতির কারণে উচ্চ রক্তচাপ তৈরি হয়েছে। যার কারণে সরকারের কানে আমাদের কথা পৌঁছায় না।

বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, দেশের প্রতিটি জায়গায় আওয়ামী শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে। বুকের তাজা রক্ত দিয়েছিল মানুষ গণতন্ত্রের জন্য। সেই গণতন্ত্রই যদি না থাকে, তাহলে রক্তের কী হবে সেটা আওয়ামী লীগকে ভাবতে হবে। আমরা সংলাপে বলেছি, জোর করে নির্বাচন করা যাবে না।

জমিয়তে উলামায়ে বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির নুর হোসেন কাশেমী বলেন, এই সরকারের পতন না ঘটানো পর্যন্ত ঘরে ফেরা ঠিক হবে না।

বিজেপি সভাপতি আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, সুলতান মনসুর এসেছেন, আসম আবদুর রব এসেছেন, ড. কামাল হোসেন এসেছেন, কাদের সিদ্দিকী এসেছেন। আর কে বাকী থাকল? আর কয়েকজন এলে তো আওয়ামী লীগেরই আর কেউ থাকবে না।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশ থেকে জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার শপথ নিতে বললেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের চেয়ারম্যান গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ কোনো রাজতন্ত্র নয়। এখানে কোনো মহারানি নেই, কোনো মহারাজা নেই। এ দেশ জনগণের। আমরা সবাই এ দেশের মালিক। তাই একটি সুন্দর, গণতান্ত্রিক দেশ আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে আমারা আমাদের সেই দাবি আদায় করেই ছাড়ব।

সমাবেশ উপলক্ষে সরকার যোগাযোগ ব্যবস্থা সীমিত করেছে— এমন দাবি করে ড. কামাল বলেন, রাস্তা বন্ধ করে, বাস বন্ধ করে জনগণকে দমানো যাবে না। সমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকার বাস, লঞ্চ বন্ধ করে দিয়েছে। এর নাম কি গণতন্ত্র? আপনারা যেভাবে এসেছেন, এমন অদম্যভাবে, আপসহীনভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার শপথ নিতে হবে।

সরকারের গুম-খুনের সমালোচনা করে গণফোরাম সভাপতি আরও বলেন, সরকার দেশটাকে জিম্মি করে রেখেছে। এই ভয়াবহ অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। এ জন্য বসে থাকার সুযোগ নেই। জনগণের কাছে যেতে হবে। তাদের জাগাতে হবে। পরিবর্তনের যে জাগরণ উঠেছে, তাকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে।

সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এ সংবিধান প্রণেতা বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হবে। দেশে আর কোনো প্রহসনের নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।

জনগণের উদ্দেশে ড. কামাল বলেন, আপনাদেরকে ভোটাধিকার পাহারা দিতে হবে। ভোটাধিকার পাহারা দেওয়া মানে স্বাধীনতাকে পাহারা দেওয়া। সুষ্ঠু নির্বাচন মানে গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখা, দেশকে বাঁচিয়ে রাখা।