News

এরদোগানকে ফাঁসাতে গিয়েই ‘ব্যাকফায়ারে’ যুবরাজ সালমান?

By editor

October 20, 2018

সৌদি আরবের বর্তমান বাদশাহ ও যুবরাজের সমালোচক সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে নির্মমভাবে হত্যা মৃতদেহ গুম করে ফেলা নিতান্তই সমালোচকের মুখ বন্ধ করার জন্য নয়। এর পেছনে বৃহৎ পরিকল্পনা ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে বলে মনে করছেন তুর্কি বিশ্লেষকরা।

জামাল খাশোগি যে শুধুমাত্র সৌদি শাসকগোষ্ঠীর সমালোচক তা নয়, বরং তিনি তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগানেরও সমালোচক ছিলেন। এরদোগানের বর্তমান শাসনব্যবস্থা নিয়ে তিনি একাধিক কলামে সমালোচনা করেছেন। তবে মৃত্যুর কিছু দিন আগে থেকে তিনি এরদোগানের প্রতি নমনীয় ছিলেন।

ফলে জামাল খাশোগিকে হত্যা, হত্যার জন্য তুরস্কের সৌদি দূতাবাস বেছে নেয়া, হত্যার পর টুকরো টুকরো করে লাশ গায়েব করে দেয়া এবং তিনি দূতাবাস থেকে বেরিয়ে গেছেন বলে সৌদির দাবি এক সূত্রে গাঁথা বলে ধারণা করা যায়।

সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গভীর বন্ধুত্ব রয়েছে। বর্তমানে সৌদি প্রশাসনের মার্কিনিদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এমন পরিস্থিতিতে সৌদি আরব থেকে দেশটির শীর্ষস্থানীয় নিরাপত্তাকর্মীদের ১৫ সদস্যের একটি দল নির্দিষ্ট হত্যাকাণ্ড ঘটাতে তুরস্কে যাচ্ছেন আর বিষয়টি সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কোনো খবরই রাখে না তা বিশ্বাস করা যায় না।

জামাল খাশোগি সৌদি সরকারের সমালোচক, শুধুমাত্র এ কারণেই যদি তাকে থামানোর প্রয়োজন হয় তাহলে সৌদি আরব সেটি অন্যভাবে করতে পারত। তুরস্কের দূতাবাসে যাওয়ার পর জামাল খাশোগিকে গ্রেফতার করে বিশেষ বিমানে সৌদি নিয়ে কারান্তরীণ করতে পারত।

কিন্তু এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, সৌদি কর্তৃপক্ষ জামাল খাশোগিকে হত্যার পর লাশ গুম করেছে এবং হত্যার বিষয়টি বরাবর অস্বীকার করেছে। এমনকি জামাল খাশোগি দূতাবাস ছেড়ে বেরিয়ে গেছে বলে দাবি করেছিল সৌদি কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু তুর্কি কর্তৃপক্ষের কঠোরতায় এবং তদন্তকারীদের তদন্তের অগ্রগতির কারণে জামাল খাশোগির দূতাবাস ছেড়েছেন সেটি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয় সৌদি আরব। ফলে শেষ পর্যন্ত তারা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।

কিন্তু জামাল খাশোগি সৌদি দূতাবাস ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বলে সৌদি আরব যে দাবি করেছিল তার পেছনেই বৃহৎ পরিকল্পনা ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ধরা পড়ে।

জামাল খাশোগি সৌদি দূতাবাস থেকে বেরিয়ে যাননি এই বিষয়টি যদি তুর্কি কর্তৃপক্ষ প্রমাণ করতে না পারতেন তাহলে তার নিখোঁজের সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব তুরস্ককেই বহন করতে হতো। সৌদি আরবের ওপর বর্তমান যে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো তুরস্ককে।

কিন্তু তুরস্ক না পারত জামাল খাশোগির সন্ধান দিতে আবার না পারত তাকে হত্যা বা নিখোঁজের দায় নিতে। ফলে আন্তর্জাতিকভাবে অবরোধসহ নানা শাস্তিমূলক পদক্ষেপের মাধ্য এরদোগান সরকারকে ঘায়েল করা সহজ হতো।

তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আনাদলু এজেন্সির একজন বিশ্লেষক বলছেন, সৌদি সরকার অনেক দিন ধরেই খাশোগিকে দেশে ফিরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করে আসছে কিন্তু সফল হয়নি। এক্ষেত্রে দেশটির যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএয়ের সঙ্গেও অনেক আলাপালোচনা হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে নেয়া অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এমনটি হলে বিশ্ব জনমত ও গণমাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে।

আনাদলু এজেন্সির ওই বিশ্লেষকের মতে, খাশোগিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে রাজি ছিল না। তার চেয়ে বরং তুরস্কে তাকে গুম করে দিয়ে সৌদি সরকার ও যুক্তরাষ্ট্র এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিল।

প্রথমত, একজন সমালোচককে সরিয়ে দেয়া এবং এর মাধ্যমে অন্য সমালোচকদের কঠোর বার্তা দেয়া। দ্বিতীয়ত, ইস্তাম্বুলে নিখোঁজ হয়ে গেলে তুরস্কের সরকারের ওপর চাপ দেয়া।এর কারণ, সাংবাদিক খাশোগি অনেক লেখায় এরদোগান সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। সেই লেখাগুলোকে সামনে এনে তার নিখোঁজ হওয়ার দোষ পুরোটাই তুরস্কের সরকারের ওপরে চাপানো।

এছাড়া তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ করে আরব বিশ্বের সরকার-সমালোচকদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল। খাশোগিকে নিরাপদে সরিয়ে দিয়ে আরব বিশ্বের সরকার-সমালোচকদেরকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছিল সৌদি আরব যে তুরস্ক আর তোমাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় নয়। আমি চাইলে তোমাদের তুরস্কের মাটিতেও নিশ্চিহ্ন করতে পারি।

কিন্তু সৌদি আরবের এমন পরিকল্পনা সহজেই মাঠে মারা গিয়েছে। কারণ, জামাল খাশোগি শেষবার যখন কনস্যুলেটে যান তখন তার বাগদত্তা বধূকে সঙ্গে করে নিয়ে যান।

তাকে কনস্যুলেট ভবনের বাইরে রেখে যান এবং সতর্ক করে দেন যে যদি তার আসতে দেরি হয় বা বিকাল ৫টার মধ্যে বের না হন তবে যেন তুরস্কের তার কয়েকজন বন্ধুকে বিষয়টা জানান।

তার এই বন্ধুদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের একজন উপদেষ্টা এবং তুরস্ক-আরব মিডিয়া সংগঠনের প্রধানও ছিলেন। তাদের মাধ্যমেই তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশ দ্রুত পদক্ষেপ নেয়।

এছাড়া জামাল খাশোগি তার হাতে থাকা অ্যাপল ওয়াচের রেকর্ডারটি চালু করে দিয়ে কনস্যুলেটে ঢুকেছিলেন। ফলে ভেতরে কী ঘটেছে তার সম্পূর্ণ রেকর্ড বাগদত্তা বধূর হাতে থাকা মোবাইলে পৌঁছে গেছে। তুর্কি গোয়েন্দারা ওই রেকর্ড উদ্ধার করেছে এবং ঘটনার বিস্তারিত উদঘাটনে সফল হয়েছে।

ফলে তুরস্কের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ও প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের ষড়যন্ত্র ও সৌদি আরবের সহযোগিতায় সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের পুরো পদক্ষেপটিই ‘ব্যাকফায়ার’ হয়েছে। কিন্তু সেই ব্যাকফায়ারের গুলিটি বিদ্ধ হয়েছে সৌদি শাসকদের বুকে। পশ্চিমা রয়েছে সম্পূর্ণ নিরাপদ। যুগান্তর