এগারোটি লক্ষ্য অর্জনে সাত দফা দাবি নিয়ে গঠিত ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’কে আন্দোলনের মাঠে, রাজপথে দেখতে চায় দেশের বাম প্রগতিশীল নেতারা। তাদের মতে, ঘোষিত দাবি নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যদি আন্দোলনের মাঠে আসতে পারে তবে জনসমর্থন পাবে।
নির্বাচন সামনে রেখে গঠিত ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে’র দাবিগুলোর সঙ্গে বাম-প্রগতিশীল দলগুলোর নির্বাচন প্রশ্নে করা দাবির মিল আছে। কিন্তু তাদের সঙ্গে কোনো ঐক্য হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন কোনো কোনো বাম নেতা। তবে আন্দোলনে মাঠে থাকলে ‘প্রত্যক্ষ ঐক্য’ তৈরি না হলেও ‘পরোক্ষ ঐক্য’ থাকে বলেও কেউ কেউ মনে করেন।
তাদের ভাষ্য মতে, ‘বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মতো দুঃশাসনের শক্তির সঙ্গে জোটবদ্ধ হবো না, বিকল্প শক্তি গড়ে তুলবো।’ তবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের রাজপথের কর্মসূচির ওপর ঐক্যের বিষয়টি নির্ভর করবে বলেও মত দেন কেউ কেউ।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু বলার সময় আসেনি বলে মনে করেন বাম নেতারা। নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার চেয়ে রাজপথে আন্দোলনে আছেন জানিয়ে তারা বলেন, ‘দেশে এখন নির্বাচনের পরিবেশ নেই, নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হলে অংশগ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফায় যা আছে :
১. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার নিশ্চিত করতে হবে।
২. গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।
৩. বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।
৪. কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সাংবাদিকদের আন্দোলন এবং সামাজিক গণমাধ্যমে স্বাধীন মত প্রকাশের অভিযোগে ছাত্রছাত্রী, সাংবাদিকসহ সবার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সব কালো আইন বাতিল করতে হবে।
৫. নির্বাচনের ১০ দিন আগে থেকে নির্বাচনের পর সরকার গঠন পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত করতে হবে।
৬. নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং সম্পূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে ভোট কেন্দ্র, পোলিং বুথ, ভোট গণনাস্থল ও কন্ট্রোল রুমে তাদের প্রবেশে কোনো প্রকার বিধি-নিষেধ আরোপ না করা। নির্বাচনের সময়ে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর যেকোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে হবে।
৭. নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচনের ফলাফল চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা ও কোনো ধরনের নতুন মামলা না দেওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।
জোটের বিষয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হবো না, আওয়ামী লীগের সঙ্গেও জোটে যাবো না। কারণ, ওই দুই শক্তিই দুঃশাসনের শক্তি। আমরা দুঃশাসনের দুই শক্তির বাইরে বামপন্থী-গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি নিয়ে একটা বিকল্প শক্তি গড়ে তুলবো।’
‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক হওয়ার সুযোগ নেই’ বলে মন্তব্য করেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলম।
নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন বিষয়ে আমরা কিছু দাবি দিয়েছি। আমাদের মতো করে আমরা লড়াই-সংগ্রামে আছি। এগুলো এখনও পরিষ্কার নয়। যদি নির্বাচন করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়, তাহলে আমরা আমাদের দল থেকে নির্বাচনে যোগ দেব।’
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা একটা জোটে অবস্থান করি। গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলবেন তারা যার যার অবস্থান থেকে জনগণের সামনে উপস্থিত হোক। গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হোক। জনগণের মৌলিক অধিকারের বিষয়ে সবাই সোচ্চার হোক। এমন আহ্বান আমাদের জোটের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।’
নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখন সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার পরিবেশ নেই। তাই নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে আমাদের অবস্থান জানানোর সময় এখনও হয়নি।’
গণতান্ত্রিক বাম জোটের নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘এটা তো অনেক আগে করার কথা ছিল। সেই জায়গা থেকে তারা (জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট) যে কথাগুলো বলছেন, এগুলো নিয়ে যদি তারা রাজপথে ধারাবাহিকভাবে থাকতে পারে, তাহলে মানুষের সমর্থন পাবে। এখনও রাজপথে কার্যকর কর্মসূচিতে তাদের দেখিনি।’
‘আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষার দাবি নিয়ে রাজপথে বহুদিন ধরে আছি। আন্দোলনের সব শক্তিগুলো রাজপথে অবস্থান নিক। রাজপথে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে এক ধরনের পরোক্ষ ঐক্য গড়ে ওঠে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেখানে নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, এসব বিষয়ে কিন্তু তাদের (জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের) কোনো কথা আমরা শুনিনি। আমরা দেখতে চাই, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক দল রাজপথে দাঁড়াক। ঐক্যবদ্ধ না হলে মানুষ কিন্তু সাহস পাবে না রাজপথে নামতে। সরকার যেভাবে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে, আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে দাঁড়ালে এই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য করতে না পারলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।’
‘আন্দোলনের মাঠে অবস্থানের ওপর নির্ভর করছে, তাদের সঙ্গে ঐক্যের বিষয়টি’- যোগ করেন তিনি।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে তিনি বলেন, জোটগতভাবে (বাম জোট) আমরা বলেছি, তফসিল ঘোষণার আগেই সংসদ ভেঙে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের কথা। এ চার দাবিতে আমরা রাজপথে আছি। আন্দোলনের মাধ্যমে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হলে আমরা বামজোট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো।
‘আমাদের প্রার্থী বাছাই চলছে। জোটগতভাবে একদিকে রাজপথের আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনের জন্য এক ধরনের রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রস্তুতি আমরা শুরু করেছি।’
গণতান্ত্রিক বাম জোটের অন্যতম নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘বিভিন্ন ধরনের জোট গঠন হচ্ছে। তারা বিভিন্ন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে এগোবে। আমরা রাজপথে আছি। রাজপথেই ঐক্যের বিষয়টি নির্ধারণ হবে।’