সাগরে জোয়ার এলে যেমন জোয়ারের পানি সবকিছু ভাসে, তেমনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জোয়ারে ভাসছে দেশ। সারাদেশে শুরু হয়েছে নির্বাচনী হাওয়া। মানচিত্রের সাড়ে ৫৫ হাজার বর্গমাইলে একই চিত্র। এ যেন ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার আনন্দে নির্বাচনী উৎসবে অংশগ্রহণের আগাম প্রস্তুতি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত সর্বত্রই চলছে আলোচনা-তর্কবিতর্ক। কোন আসনে কারা প্রার্থী হচ্ছেন, কোন জোট থেকে কারা নমিনেশন পাচ্ছেন, মনোনয়ন-প্রত্যাশীরা কে কোন জাঁদরেল নেতার বাসায় দৌড়াচ্ছেন, কারা টাকার বিনিময়ে নমিনেশন ক্রয়ের চেষ্টা করছেন, কোন মন্ত্রী-এমপির দলীয় নমিনেশন পাওয়ার সম্ভাবনা কম, জেলায় আসনগুলোতে নতুন মুখ কারা আসছেন- এসব নিয়েই চলছে আলোচনা-চুলচেরা বিশ্লেষণ। দেশের মানুষের কাছে ‘নির্বাচন মানে যে উৎসব’ তা যেন ঘরে ঘরে ধরা দিয়েছে বাস্তব হয়ে।
তফসিল ঘোষণার পর ৯ নভেম্বর শুক্রবার থেকেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে মনোনয়নপত্র বিক্রি নিয়ে উৎসব চলছে। হাজার হাজার কর্মী-সমর্থন দিয়ে শোডাউন করে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হতে সম্ভাব্য প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র ক্রয় করছেন। দলীয় সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয় ও বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চলছে নির্বাচনী উৎসব। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যাবে কি-না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় মানুষের মধ্যে উশখুশ ছিল। কিন্তু জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয়ার পর ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের সারাদেশের নেতাকর্মীদের মধ্যে আছড়ে পড়ে নির্বাচনের ঢেউ। শুরু হয় ভোট উৎসব। আজ নয়াপল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করবে বিএনপি।
ফরম ক্রয়ের জন্য ইতোমধ্যেই সারাদেশের সম্ভাব্য প্রার্থীরা কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ফরম ক্রয়ের জন্য ঢাকার পথে রওয়ানা দিয়েছেন। এরশাদের জাতীয় পার্টি, বি. চৌধুরীর যুক্তফ্রন্টসহ অন্যান্য দল জোটগুলোতেও মনোনয়ন ফরম ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে উৎসব চলছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট এবং বিএনপিসহ কয়েকটি শরিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মূল প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে মাঠে নামায় নির্বাচনের প্রবল বাতাস সারাদেশে বইতে শুরু করেছে। শুধু রাজনীতিকরাই নয়, নির্বাচনে প্রার্থী হতে দৌড়ঝাপ শুরু হয়েছে সাবেক আমলা, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা, ক্রিকেটার, ফুটবলার, সিনেমার নায়ক-নায়িকা, কণ্ঠশিল্পী, সাবেক ছাত্রনেতা, নাটকের অভিনেতা-অভিনেত্রী-ভিলেন-সাংবাদিক-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-এনজিওকর্মী-আইনজীবীসহ সব পেশার মানুষের মধ্যে। সবার লক্ষ্য আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এমনকি ছোট ছোট দল ও জোটগুলো থেকে মনোনয়ন নিশ্চিত করে ভোট যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া। অংশগ্রহণমূল নির্বাচন নিশ্চিত করতে ইসিতেও রাজনৈতিক দলগুলোর ভিড় বাড়ছে।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে ভোটে যাচ্ছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। গণভবনে সংলাপ সফল না হলেও নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পরিবেশে নির্বাচনের জন্য আন্দোলনের অংশ হিসেবেই ঐক্যফ্রন্ট সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে ড. কামাল হোসেন ভোটে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়ে তফসিল বাতিল করে তা এক মাস পিছিয়ে নতুন তফসিল ঘোষণার দাবিও জানিয়েছেন। এর আগে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ২০ দলীয় জোটের পক্ষে কর্নেল (অব.) আলি আহমদ সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। তবে তিনি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড গঠনের দাবি জানান। অন্য দিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকালও ঐক্যফ্রন্টকে নির্বাচনে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ‘এবার অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। আমার লক্ষ্যই হলো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেয়া’। নির্বাচনের তারিখ পেছানোর জন্য ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওই চিঠিতে নির্বাচনী প্রস্তুতি সংক্রান্ত সময় চেয়ে তারিখ কয়েকদিন পেছানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে। বি. চৌধুরীর যুক্তফ্রন্ট থেকেও নির্বাচনের তারিখ পেছানোর দাবি জানিয়ে ইসিতে চিঠি দেয়া হয়েছে। এর আগে বি. চৌধুরী নির্বাচনের তারিখ এক সপ্তাহ পিছিয়ে ৩০ ডিসেম্বর করার অনুরোধ জানিয়েছেন প্রেসিডেন্টের প্রতি। একই সঙ্গে তিনি প্রেসিডেন্টকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড গঠনে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশনা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যেই জেলা রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিসিদের নির্বাচনী আচরণবিধির ব্যাপারে কড়া নির্দেশনা পাঠিয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, অংশীজনের আবেদনে ইসি যদি নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দেয়, তা হলে আমাদের আপত্তি থাকবে না। আবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে নির্বাচন কমিশনে ‘নৌকা’ ও ‘ধানের শীষ’ প্রতীক নিয়ে শরিক যেসব দল প্রার্থী দেবে; সে তালিকা পাঠিয়ে দিয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা জানিয়েছেন, আজ সোমবার ইসির বৈঠক হবে। ওই বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ পেছানো হবে কি হবে না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। তবে ইসি সূত্রে জানা গেছে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে ভোটের তারিখ কয়েকদিন পিছিয়ে দেয়া হতে পারে।
এদিকে ইনকিলাবের ব্যুরো অফিস, আঞ্চলিক অফিস, জেলা, উপজেলা সংবাদদাতারা জানান, সর্বত্রই শুরু হয়েছে নির্বাচনী আমেজ। জেলা শহর, উপজেলা শহর, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, গ্রামের হাটবাজার, রাস্তার মোড় সবখানেই সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু নির্বাচন। তাদের আসনে কারা কোন দলের প্রার্থী হচ্ছেন, কে বিদ্রোহী প্রার্থী হতে পারেন, শরিক দলগুলোর কারা কারা নমিনেশন পাচ্ছেন, পুরনো মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে কারা মনোনয়ন পাচ্ছেন না এবং কোন দল ও প্রার্থীর জনসমর্থন কেমন সে সবই মূলত আলোচনার বিষয়বস্তু। চায়ের টেবিলে আড্ডায় আছড়ে পড়ছে নির্বাচনী ঝড়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা অনেক আগ থেকেই নির্বাচনী মুড়ে রয়েছেন। দীর্ঘ দিন থেকে তারা দলীয় নমিনেশন ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে বিরোধ, সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ করছেন। নমিনেশন নিশ্চিতের আশায় কেন্দ্রীয় নেতাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন। নানা পন্থায় নিজেদের জনসমর্থনের প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করছেন। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী এবং বর্তমান সংসদের এমপি রয়েছেন এমন প্রায় অর্ধশত নেতাকে নির্বাচনী এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগেরই মনোনয়ন-প্রত্যাশী নেতারা। অনেক নেতা ও এমপিকে এলাকায় ঢুকতে পর্যন্ত দেয়া হচ্ছে না। অন্য দিকে বিএনপির নেতারা বছরের পর বছর ধরে হামলা মামলার ভারে ন্যূজ। অনেকেই আত্মগোপন এবং পালিয়ে ছিলেন। কেউ কেউ হামলা-মামলার ভয়ে দলে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। ব্যবসা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন এমন নেতার সংখ্যাও কম নয়। কেউ কেউ এখনো কারাভোগ করছেন। এ ছাড়াও নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট অংশগ্রহণ করবে কি-না তা নিয়েও ছিল অনিশ্চয়তা। কিন্তু গতকাল নির্বাচনে অংশগ্রহণকে খালেদা জিয়ামুক্তিসহ সাত দফা দাবির আন্দোলনের অংশ হিসেবে নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর বিএনপির তৃণমূলের নেতারাও প্রকাশ্যে চলে এসেছেন। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া রুপসা থেকে পাথুরিয়া সর্বত্রই এমন দৃশ্য নির্বাচনের আবহ।
রাজধানীতে গতকাল আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র ক্রয় করতে আসার সম্ভাব্য প্রার্থীদের মিছিলের পর মিছিল, সঙ্গে মোটরসাইকেল, পিকআপ ভ্যান ও বাসে চড়ে সমর্থকদের মহড়া অসহনীয় যানজটের সৃষ্টি করে। ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয় ও বঙ্গবন্ধু এভিনিউ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মনোনয়ন-প্রত্যাশীরা নিজেদের সামর্থ্য-শক্তি ও সমর্থন বোঝানোর জন্য শোডাউন করেন। শোডাউন করতে গিয়ে ৯ নভেম্বর মোহাম্মদপুর এলাকায় জাহাঙ্গীর করিব নানক ও মোহাম্মদপুর থাকা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাদেক খানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে দু’জন প্রাণ হারিয়েছে। মনোনয়নপত্র ক্রয়ে যেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন-প্রত্যাশীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। কোনো ধরনের সিগন্যাল বা নিয়মের তোয়াক্কা না করে শোডাউন করছে সরকার দলীয় সমর্থকরা। ধানমন্ডি এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে মিছিল করছেন তারা। প্রতিটি মিছিলের সঙ্গে রয়েছে মোটরসাইকেলের বহর। আর এসব বহরেও মানা হয়নি ট্রাফিক আইন। ৯ নভেম্বর শুক্রবার মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু হয়। তিন দিনে প্রায় চার হাজার ৩৫টি মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়। প্রতিটি মনোনয়নপত্র বিক্রি হয় ৩০ হাজার টাকা করে। এতে আওয়ামী লীগের দলীয় তহবিলে আসে প্রায় ১২ কোটি ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অন্য দিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপি আজ সকাল ১০টা থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করবে। দুদিন এই ফরম ক্রয় করা যাবে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, ১৪ নভেম্বরের মধ্যে মনোনয়ন ফরম জমা দিতে হবে। তবে কেউ চাইলে ১৩ নভেম্বরও জমা দিতে পারবেন। ফরমের মূল্য ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা; আর জমা দিতে লাগবে ২৫ হাজার টাকা।
জাতীয় সংসদের গৃহপালিত বিরোধী আওয়ামী লীগের বি-টিম খ্যাত এরশাদের জাতীয় পার্টি গতকাল দলীয় মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করেছে। গতকাল গুলশানের ইনামুল সেন্টারে সম্ভব্য প্রার্থীদের মধ্যে মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু হয়। সারাদেশ থেকে আসা দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা হাজার হাজার সমর্থক মিছিল নিয়ে জড়ো হয় ইমানুয়েলস সেন্টার থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহের জন্য। কেউ কেউ ব্যান্ড পার্টির তালে তালে বিশাল আকৃতির লাঙ্গল নিয়ে এসে ফরম সংগ্রহ করেন। এইচ এম এরশাদ তিনটি আসনে প্রার্থী হওয়ার লক্ষ্যে ফরম সংগ্রহ করেছেন। অন্যান্য দলগুলোও নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। এতে সারাদেশের আকাশে-বাতাসে এখন আওয়াজ নির্বাচন-নির্বাচন এবং নির্বাচন।